Wednesday, January 22, 2025
topপড়াশোনাপ্রবন্ধ

শিক্ষকতা: মহান পেশা—আনোয়ারুল দুর্জয়

শিক্ষকতা হলো এমন একটি পেশা, যা কেবল কাজ নয়; এটি দায়িত্ব, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের এক পরিপূর্ণ সমন্বয়। শিক্ষকরা শুধু একটি পেশার মানুষ নন; তাঁরা একজন পথপ্রদর্শক, দার্শনিক এবং সমাজ পরিবর্তনের কারিগর। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে যে আলো দেখা যায়, তা আসলে শিক্ষকদেরই প্রদীপ থেকে প্রজ্বলিত।

শিক্ষকতার তাৎপর্য

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে সেই আলোকে জ্বালিয়ে তোলা, যা তাকে তার প্রকৃত সত্তার সন্ধান দেয়।” আর এই আলো জ্বালানোর কাজটিই করেন শিক্ষকরা। তাঁরা শুধু পাঠ্যপুস্তকের সীমায় আবদ্ধ থাকেন না; তাঁরা গড়ে তোলেন মনুষ্যত্বের বুনিয়াদ।

একজন শিক্ষক যখন কোনো শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন, তখন সেটি কেবল একটি ব্যক্তির জীবন নয়; একটি গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বদলে দেয়। এই কারণেই শিক্ষকতা এক মহৎ পেশা—এমন একটি পেশা, যার সঙ্গে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

শিক্ষকের গুরুত্ব: উদাহরণে প্রকাশ

বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, “আমি আমার শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তাঁরা শুধু আমাকে গণিত বা পদার্থবিদ্যা শেখাননি; তাঁরা আমাকে শেখানোর মাধ্যমে জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছেন।” এই কথাটি শুধু আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেই নয়; আমাদের জীবনের প্রতিটি প্রান্তে শিক্ষকদের অবদান ছড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার মতো শিক্ষকেরা আমাদের জাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্র আজ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু কুদরত-ই-খুদা নিজে কখনো তাঁর অবদান নিয়ে অহংকার করেননি। এমন শিক্ষকেরা প্রমাণ করেছেন যে, প্রকৃত শিক্ষক কেবল শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না; তাঁদের প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।

শিক্ষকতা: আত্মতৃপ্তির পেশা

একজন শিক্ষক হয়তো বাহ্যিকভাবে খুব বেশি স্বীকৃতি পান না। তবে প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি তখনই আসে, যখন কোনো ছাত্র মানুষের মতো মানুষ হয়ে শিক্ষকের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন আদর্শ শিক্ষক এই আত্মতৃপ্তির মাঝেই খুঁজে নেন তাঁর প্রকৃত স্বীকৃতি। আদর্শ শিক্ষক সর্বদা আদর্শ ছাত্র, আবার আদর্শ মানুষ। তাঁরা জ্ঞানের পাশাপাশি মূল্যবোধের মশাল জ্বালান, যা শিক্ষার্থীদের অন্তর্গত অন্ধকারকে দূর করে।

সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা

আজকের সমাজে শিক্ষকতার পেশাকে অনেক সময় ভুলভাবে দেখা হয়। অথচ, জাতির ভিত্তি তৈরিতে তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একজন শিক্ষক যদি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তবে তিনি একাই একটি প্রজন্মকে বদলে দিতে পারেন। যেমনটি দেখেছি আমরা বিশ্বনেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনে, যিনি তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকেই শিখেছিলেন স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মর্ম।

উপসংহার

শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়; এটি একটি সাধনা, একটি জীবনের আরাধনা। একজন শিক্ষক যে আলো জ্বালিয়ে যান, তা শুধু একজন মানুষের নয়, একটি জাতির ভাগ্য নির্মাণ করে। একজন মহান শিক্ষক একদিন হয়তো ভুলে যাওয়া হয়, কিন্তু তাঁর শিক্ষা চিরকাল বেঁচে থাকে তাঁর ছাত্রদের মাঝে।

তাই, সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, “শিক্ষকরা কেবল ছাত্রদের স্বপ্ন দেখান না; তাঁরা তাঁদের দেখানো স্বপ্ন পূরণ করার পথও প্রশস্ত করেন।” পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত জাতির পেছনে শিক্ষকদের অবদান চিরকাল অমর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *